তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি

বিভ্রান্তির কারণঃ তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আমরা তন্মধ্যে মৌলিক কারণগুলি উল্লেখ করলামঃ

১. আল্লাহ্‌র কর্মকে সৃষ্টির কর্মের সাথে তুলনা করাঃ ভ্রান্ত প্রধান ফের্কাগুলি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেটি প্রশংসনীয়, আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও ঐ একই জিনিসকে প্রশংসনীয় ভেবেছে। পক্ষান্তরে যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিন্দনীয়, সেটিকেই আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও নিন্দনীয় মনে করেছে। যেমনঃ তারা বলেছে, মানুষের ক্ষেত্রে যা ‘ন্যায়’ হিসাবে খ্যাত, আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও তা ‘ন্যায়’ হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে মানুষের ক্ষেত্রে যাকে ‘যুলম’ গণ্য করা হয়, তা আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও ‘যুলম’ হিসাবেই গণ্য হবে। তাক্বদীরকে ঘিরে বিভ্রান্তির এটি অন্যতম প্রধান কারণ।

২. আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য না করা: তারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টিকে একই গণ্য করেছে। সুতরাং যেসব বিষয়ের প্রতি আল্লাহ শরঈভাবে সন্তুষ্ট নন, তাদের দৃষ্টিতে সেগুলিকে তিনি সৃষ্টিগতভাবেও চাননি। যেমনঃ যেহেতু আল্লাহ কুফরীসহ অন্যান্য অন্যায়-অপকর্মকে ভালবাসেন না, সেহেতু তিনি সেগুলি সৃষ্টিও করেননি।

৩. মানুষের সংকীর্ণ বোধশক্তিকে ভাল-মন্দ নির্ণয়ের মানদণ্ড গণ্য করাঃ তাদের দৃষ্টিতে, আল্লাহ্‌র রাজ্যে যা কিছু হয়, সেগুলির ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করবে মানুষের আক্বল বা বোধশক্তি। সুতরাং আল্লাহ্‌র সৃষ্টিসমূহের মধ্যে যেগুলিকে আক্বল ভাল মনে করবে, সেগুলিই ভাল হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে আক্বল যেগুলিকে মন্দ গণ্য করবে, সেগুলি মন্দ হিসাবেই পরিগণিত হবে এবং সেগুলিকে আল্লাহ্‌র দিকে সম্বন্ধিত না করা যরূরী হবে।

৪. আল্লাহ্‌র প্রত্যেকটি কর্মের রহস্য উদঘাটনের ব্যর্থ প্রয়াস চালানোঃ তাক্বদীরের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমর্মে প্রশ্ন করা যে, ‘এটি কেন হল?’ কারণ এ জাতীয় প্রশ্ন মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়।[1]


কে সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে অস্বীকার করে?: তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেজন্য জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামের আবির্ভাবের পরে আরবে কেউ তাক্বদীরকে অস্বীকার করত না। কিন্তু গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শনের বই-পুস্তক মুসলিম দেশসমূহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাক্বদীরকে ঘিরে ফেতনা শুরু হয়। দিমাশ্‌ক এবং বাছরা নগরীতে সর্বপ্রথম এই ফাসাদ শুরু হয়। মক্কা-মদীনাতে ইলমের ব্যাপক চর্চা থাকার কারণে সেখানে এমন ফেতনা প্রবেশ করতে পারে নি।[2]

বাছরার অধিবাসী অগ্নিপূজকদের ঘরের সন্তান ‘সিসওয়াইহ্‌’ বা ‘সাওসান’ নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে ঘিরে বিদ‘আত সৃষ্টি করে। ইমাম আওযা‘ঈ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইরাকের অধিবাসী সাওসান নামক এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য পেশ করে। এই ব্যক্তি মূলতঃ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিল, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলেও কিছুদিন পর আবার খ্রীষ্টান ধর্মে ফিরে যায়। তার কাছ থেকে তাক্বদীর অস্বীকারের এই মন্ত্র গ্রহণ করে মা‘বাদ জুহানী এবং মা‘বাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে গায়লান’।[3] এই দু’জনের পরে ওয়াছেল ইবনে আত্বা এবং আমর ইবনে ওবাইদ এই মতবাদের প্রচার-প্রচারণা শুরু করে।[4]

ইমাম মুসলিম (রহেমাহুল্লাহ) ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে ইয়া‘মুর (রহেমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহ্‌ইয়া বলেন, ‘বাছরায় মা‘বাদ জুহানী নামীয় এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর অস্বীকার করে। আমি এবং হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান হিম্‌ইয়ারী হজ্জ্ব বা ওমরা পালন করতে গেলাম। আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম, যদি কোন ছাহাবীর সাথে আমাদের দেখা হয়, তাহলে তাঁর কাছে তাক্বদীর অস্বীকারকারীদের বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। যাহোক, আমরা দু’জন ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে মসজিদে প্রবেশ করতে দেখে তাঁকে দু’পাশ থেকে ঘিরে দাঁড়ালাম। আমি কথা শুরু করলাম, বললাম, হে আবু আব্দির রহমান! আমাদের এলাকায় কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা কুরআন পড়ে, ইলম অর্জন করে... ইত্যাদি। কিন্তু তারা মনে করে, তাক্বদীর বলে কিছু নেই, আল্লাহ্‌র অজান্তেই সবকিছু এমনি এমনি হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, ‘তাদের সাথে যদি তোমাদের দেখা হয়, তাহলে বলে দিও, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কসম করে বলছে, তাদের কারো যদি উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ হয় এবং সে তা দান করে দেয়, তবুও তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আল্লাহ তার ঐ দান গ্রহণ করবেন না’। অতঃপর তিনি বললেন, আমার পিতা ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আমাকে বর্ণনা করেছেন...। এরপর তিনি হাদীছে জিবরীল নামে প্রসিদ্ধ হাদীছটি উল্লেখ করলেন।[5]

এরপর উমাইয়া শাসনামলের শেষের দিকে জাবরিইয়াহ্‌দের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মতে, বান্দা ইচ্ছা শক্তিহীন বাধ্যগত জীব। জাহ্‌ম ইবনে ছাফওয়ান নামক এক ব্যক্তি এই ভ্রান্ত মতবাদের পুরোধা।[6]

[1]. ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয আলুশ্‌-শায়খ, জামে‘ শুরূহিল-আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৪১-৫৪৩।

[2]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/১৬৩।

[3]. ইমাম আজুর্‌রী, আশ্‌-শারী‘আহ, তাহক্বীক্ব: ড. আব্দুল্লাহ দুমায়জী, ‘তাক্বদীরের বিষয়টি কিভাবে এবং কেন হয়? ইত্যাদি অনুসন্ধান বর্জন করতে হবে আর ইহার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং আত্মসমর্পণ করতে হবে’ অনুচ্ছেদ (রিয়ায: দারুল ওয়াত্বান, তা.বি), ২/৯৫৯; ইমাম লালকাই, শারহু উছূলি ইতিক্বাদি আহলিস্‌-সুন্নাহ, ‘ইসলামে তাক্বদীর অস্বীকারের বিষয়টি কবে শুরু হয়’ অনুচ্ছেদ, (রিয়ায: দারু ত্বায়বাহ, তা.বি), ৪/৭৫০।

[4]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৬৪।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের বর্ণনা, তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি তাক্বদীরে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা’ অনুচ্ছেদ।

[6]. ওমর সুলায়মান আশক্বার, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/২৩।